Monday, March 14, 2016

Nari O Gonomaddam/ নারী ও গণমাধ্যম


প্রথম অধ্যায়

১.১ ভুমিকাঃ

গণমাধ্যমের শক্তি অসীম। আর শক্তিশালী মাধ্যম হিসেবে সামাজিক কিংবা রাষ্ট্রীয় পরিবর্তনে রয়েছে গণমাধ্যমের গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব। গণমাধ্যমের সঠিক ব্যবহারে যেমন চিত্তের বিনোদন, জ্ঞানের উৎকর্ষ সাধন, পারস্পরিক ও আঞ্চলিক সহযোগিতা সহনশীলতা, মানবিক বোধের উন্নতি ঘটে তেমনি এর অসতর্ক প্রয়োগে ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্র ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে। প্রকৃত পক্ষে গণমাধ্যম এমনই এক শক্তিশালী ও প্রভাবশালী সংগঠন  বা মাধ্যম, যার সুষ্ঠ ও পরিছন্ন ব্যবহারে বিরাজ করে সমাজে শান্তি, সমতা এবং অভূতপূর্ব উন্নয়ন। তাই গণমাধ্যম নারী উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে।

জাতীয় উন্নয়নের জন্য গণমাধ্যমের বিকাশ অতীব জরুরি। জাতীয় উন্নয়নের জন্য নারী সমাজেরও উন্নয়নের প্রয়োজন। কারণ জনসংখ্যার অর্ধেক এ নারীসমাজের উন্নয়ন না হলে জাতীয় উন্নয়ন টেকসই হবে না। তাই বর্তমানে নারী গণমাধ্যমগুলো উনয়নের জন্য নাটক, ফিচার, ম্যাগাজিন, টেলিভিশন, চলচিত্র, বিজ্ঞাপন, সংবাদপত্র, সাহিত্য ইত্যাদি প্রকাশ করে জনগণকে নারী উন্নয়ন সম্পর্কে সচেতন করে অর্থাৎ নারী উন্নয়নে উল্লেযোগ্য ভূমিকা পালন করছে।


১.২ নারীর সংজ্ঞাঃ

মানবজাতির দুই অংশের মধ্যে একটি পুরুষ ও একটি নারী। সেক্স অর্থ নারী। জৈবিক কারণে কেউ পুরুষ হয়ে জন্মায় কেউ নারী। নারী ও পুরুষের জৈবিক পার্থক্য রয়েছে যেমন, নারী   সন্তান জন্মদান করে এবং সন্তান ধারণ ও লালোনের জন্য কতিপয় ভূমিকা পালন করে তাই বলা যায় জৈবিক চিহ্নের ভিত্তিতে নারী ও পুরুষের মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য করার জন্য “সেক্স” প্রত্যয়টি ব্যবহার করা হয়।

নারীবাদ শব্দটির ইংরেজী প্রতিশব্দ হচ্ছে ‘ঋবসরহরংযস’ ইংরেজি ‘ঋবসরহরংযস’ শব্দটি এসেছে ফরাসি শব্দ ‘‘ঋবসসব’ থেকে, যার অর্থ নারী (ডড়সবহ)। এই ‘‘ঋবসসব’ শব্দটির সাথে ‘রংস’ যুক্ত হয়েছে নারীবাদ বা ‘ঋবসরহরংযস’ । ১৮৮০ সালে ফ্রান্সে নারীবাদ শব্দটির ব্যবহার শুরু হয়।


বিভিন্ন তাত্ত্বিক নারীবাদের সংজ্ঞা বিভিন্ন ভাবে দিয়েছে নিম্নে উপস্থাপন করা হলোঃ-

অধ্যাপক জুডিথ অ্যাস্টেলারার মতে, “নারীবাদ হচ্ছে সামাজিক রুপান্তর ও আন্দোলনের লক্ষে একটি পরিকল্পনা, যা নারী নিপীড়ন বন্ধ করার চেষ্টা করে।”

রোজালিন্ড ডেলসার এর মতে “সাধারণভাবে নারীবাদ বলতে বুঝায় সমাজে নারীর অবস্থান পরিবর্তনের জন্য সক্রিয় আগ্রহ।”

সুতরাং বলা যায়, নারীবাদ হচ্ছে এমন একটি তাত্ত্বীয় কাঠামো ও প্রয়োগিক প্রয়াস, যা নারী সমাজের উপর পুরুষতান্ত্রিক সমাজের বহুমাত্রিক নির্যাতন এর কারন ও ফলাফল এবং নারী মুক্তির ব্যবস্থাপত্র প্রদান করে থাকে।

১.৩ গণমাধ্যম এর সংজ্ঞাঃ

ইংরেজী ‘গধংং গবফরধ’ শব্দটির বাংলা প্রতিশব্দ হচ্ছে গণমাধ্যম। গধংং অর্থ ‘গণ’ আর গবফরধ’ অর্থ ‘মাধ্যম’। সুতরাং ‘গণমাধ্যম’ হচ্ছে জনগণের মাধ্যম। বাংলাদেশে বিভিন্ন ধরণের গণমাধ্যম আছে। যেমন- রেডিও, টেলিভিশন, সংবাদপত্র, সাময়িকী, বই, চলচিত্র, ইন্টারনেট ইত্যাদি। এসব গণমাধ্যম থেকে আমরা বিভিন্ন ধরণের তথ্য পেয়ে থাকি।

আধুনিক পৃথিবীতে গণমাধ্যম আমাদের দৈনন্দিন বাস্তবতার অংশ। সংবাদ পত্র, সাময়িকী, বই চলচিত্র, টেলিভিশন, রেডিও বা ইন্টারনেট যত ধরণের গণমাধ্যম রয়েছে, আমরা কেউ তার আওতার বাইরে নই, সারাদিন একবার গণমাধ্যম সংস্পর্শে আসে নি, আধুনিক শহরে মানুষের পক্ষে এ ঘটনাটি ঘটা একবারেই অসম্ভব।

গণমাধ্যমের সাথে নারীর একটা সম্পর্ক রয়েছে। গণমাধ্যমে আমরা নারীর বিভিন্ন ইমেজ দেখতে পাই। গণমাধ্যমের মাধ্যমে বিভিন্ন প্রকার ‘মাধ্যম বা গবফরধ’ হতে পারে যা অতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

সুতরাং বলা যায়, “ গণমাধ্যম” হচ্ছে জনগণের মাধ্যম যা উন্নয়ন ক্ষেত্রে ব্যপক প্রভাব বিস্তার করে থাকে।


 ১.৪ অধ্যায় বিন্যাসঃ

“নারী ও গণমাধ্যম প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ” শীর্ষক টার্ম পেপারটি পাঁচটি অধ্যয়ে বিন্যাস্ত করা হচ্ছে। এদের প্রতিটি অধ্যায়ের অনুচ্ছেদ সমূহ হলোঃ-

প্রথম অধ্যায় ঃ (ভূমিকা, নারীর সংজ্ঞা, গণমাধ্যমের সংজ্ঞা, অধ্যায় বিন্যাস)।

দ্বিতীয় অধ্যায়ঃ (নারী ও গণমাধ্যমের বিভিন্ন দিক, নারী ও উন্নয়নে গণমাধ্যমের ভূমিকা, বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়ন)।

তৃতীয় অধ্যায়ঃ (বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে পূর্বে নারীদের অবস্থান, বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে বর্তমানে নারীদের অবস্থান, নারীদের উন্নয়নের ক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকা ও নেতিবাচক ভূমিকা)।

চতুর্থ অধ্যায়ঃ (নারীদের ক্ষামতায়নের পথে বাধা সমূহ, বাংলাদেশে নারীর বিরুদ্ধে সন্ত্রাস বা নারী নির্যাতন, বিভিন্ন ধর্মে নারীর মর্যাদা, নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় জাতিসংঘের পদক্ষেপ বা উদ্যোগ সমূহ)।

পঞ্চম অধ্যায়ঃ (মূল্যায়ন, গ্রন্থপুঞ্জি সমূহ)।


 দ্বিতীয় অধ্যায়

২.১ নারী ও গণমাধ্যমের বিভিন্ন দিকঃ

গণমাধ্যম ও নারীর সম্পর্কটি তিনটি দিক থেকে দেখা যেতে পারে। এ তিনটি দিক নিম্নে আলোচনা করা হলোঃ

১.     গণমাধ্যমে নারীর রুপায়নঃ

বাংলাদেশের গণমাধ্যমে নারী যেভাবে চিত্রিত হয় তাকে যদি দুটি শব্দে সংক্ষিপ্ত করতে হয় তবে শব্দ দুটি হবে: ‘প্রান্তিক’ ও ‘নেতিবাচক’। গণমাধ্যম সংক্রান্ত বিভিন্ন গবেষণায় নারী উপস্থাপনের যে চিত্র ফুটে উঠে তা হলোঃ-

ক. সংবাদ মাধ্যমে নারীকে স্থান দেয়া হয় অত্যন্ত কম। মনে করা হয়, পুরুষই ঘটনার সংঘটক, নারী ঘটনার অক্রিয় অংশ।

খ. সংবাদ মাধ্যমে নারী যখন উপস্থিত হয়, তখন তাকে বেশি পাওয়া যায় দুটি ক্ষেত্রে, অপরাধ ও বিনোদন। অপরাধের ক্ষেত্রে নারী এর শিকার এবং বিনোদনের ক্ষেত্রে সামগ্রী।

গ. সংবাদ মাধ্যমে নারী বিষয়ক সংবাদকে সংখ্যা পরিমাণগত দিক থেকে বৃদ্ধি পেলেও গুণগত দিক থেকে সংবাদ নারীর যথাযথ মর্যাদা প্রদানের বিষয়টি এখনো প্রশ্নসাপেক্ষ রয়ে গেছে।

ঘ. বিজ্ঞাপনে নারী সরাসরিভাবে পণ্য।

ঙ. চল”িত্রে ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়নের মতো গুরুতর অপরাধকে বিনোদনের উপজীব্য করে তোলা হয়।

২. পেশাজীবী হিসেবে গণমাধ্যমে নারীর অংশ গ্রহণের মাত্রাঃ-

প্রচার মাধ্যমে নারীর অংশগ্রহণের বিষয়টি দুটি দিক থেকে চিন্তা করা হয়ঃ-

ক. গণমাধ্যমে নারীর নেতিবাচক ও প্রান্তিক ভাবমুর্তি গঠনের সংঙ্গে গণমাধ্যম পেশায় নারীর অংশগ্রহণের বিষয়টি প্রত্যক্ষভাবে সম্পর্কিত বলেও অনেকে মনে করেন। দেখা যায় বিভিন্ন গণমাধ্যমের সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী পর্যায়ে এবং গণমাধ্যমের আধেয় তৈরিতে নারীর উপস্থিতি নগণ্য কিংবা নেই বললেই চলে।

খ. গণমাধ্যম কর্মক্ষেত্রে যদি নারীর উপস্থিতি যথেষ্ট না হয়, তবে কর্মজীবনের সকল ক্ষেত্রে নারীকে সমান অধিকার দেয়া হয়েছে একথা বলা যায় না।



৩. অডিয়েন্স নারীঃ

আমাদের রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি ধর্ম আইন সমস্ত কিছুর মধ্যে রয়েছে পুরুষের চোখে দেখে বিশ্লেষণ। নারীর বক্তব্য, তার সমস্যা যদি অনুপস্থিত থাকে সবসময়, তবে বলা যায় নারীর সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা, তার ন্যায্যতা অর্জন একটি আকাশকুসুম কল্পনামাত্র হয়ে থাকবে।

গণমাধ্যমের সাথে নারীর ইতিবাচক সম্পর্কই ইমেজ গড়ে তোলার মাধ্যমঃ-

১৯৯৫ সালের চতুর্থ বিশ্ব নারী সম্মেলনে নারী উ্ন্নয়নের পথে ১২টি বাধা শনাক্ত করা হয় ‘গণমাধ্যম’ তার মধ্যে একটি।

বেইজিং প্লাটফরম ফর অ্যাকশন এর পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ সরকার ১৯৯৭ সালে যে নারী উন্নয়ন নীতিমালা গ্রহণ করেছে“গণমাধ্যম ও নারী” বিষয়ক অংশে নিম্নলিখিত বিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহণ করার প্রতিশ্রুতি দেয়া আছেঃ-

১.     গণমাধ্যমে নারীর সঠিক ভূমিকা প্রচার, প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করা এবং অংশগ্রহণ বৈষম্য দূর করা, গণমাধ্যমে নারী ও মেয়ে শিশুর অংশগ্রহণ, মতামত প্রকাশ, সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগ বৃদ্ধি এবং নারী ও মেয়ে শিশুর ইতিবাচক প্রতিফলন ঘটানো।

২.     নারীর প্রতি অবমাননা করা, নেতিবাচক, সনাতন প্রতিফলন এবং নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা বন্ধের লক্ষ্যে প্রচার ব্যবস্থা করা।

৩.     বিভিন্ন গণমাধ্যমের ব্যবস্থাপনা ও আনুষ্ঠানিক প্রশিক্ষণের নারীর জন্য সমান সুযোগ রাখা।

৪.     প্রচার মাধ্যমের নীতিমালার জেন্ডার প্রেক্ষিতে যুক্ত করা।

উপযুক্ত সুপারিশগুলো যদি পুরোপুরিভাবে বাস্তবায়ন করা যায়, তাহলে গণমাধ্যমের সাথে নারীর একটি ইতিবাচক সম্পর্ক গড়ে উঠবে।


২.২ নারী উন্নয়নে গণমাধ্যমের ভূমিকাঃ

জাতীয় উন্নয়নের জন্য গণমাধ্যমের বিকাশ অতীব জরুরি। গণমাধ্যমের শক্তি অসীম আর শক্তিশালী মাধ্যম হিসেবে সামাজিক কিংবা রাষ্ট্রীয় পরিবর্তনে রয়েছে গণমাধ্যমের গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব।

১.     নারীদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করাঃ বর্তমানে বিভিন্ন গণমাধ্যম যেমন- টিভিতে নারীদের অধিকার বিষয়ক খন্ড নাটক, নাটিকা, বিভিন্ন ধরণের আলোচলা অনুষ্ঠান ইত্যাদি হচ্ছে। ফলে নারীরা অধিকার সম্পর্কে সচেতন হচ্ছে।

২.     নারীদের শেক্ষা সম্পর্কে সচেতন করাঃ  শিক্ষাই জাতির মেরুদন্ড। শিক্ষা ছাড়া কোন জাতী উন্নতি লাভ করতে পারে না। নারীদের এই পিতৃতান্ত্রিক সমাজে শিক্ষা ছাড়া উন্নতি সম্ভব নয়। বিভিন্ন গণমাধ্যম নারী শিক্ষার গুরুত্ব সম্পর্কে বিভিন্ন বিষয় প্রচার করছে। ফলে নারীদের শিক্ষা সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ছে এবং নারীরা বেশি শিক্ষিত হচ্ছে।

৩.     পিতৃতান্ত্রিক মূল্যবোধ পরিবর্তনে ইতিবাচক ভূমিকা রাখাঃ আমাদের সমাজ পিতৃতান্ত্রিক সমাজ। নারীরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে পুরুষের চেয়ে পিছনে। নারীর উন্নয়ন না হলে সমাজের উন্নয়ন হবে না, আর পিতৃতান্ত্রিক মূল্যবোধ দূর না হলে নারী উন্নয়ন সম্ভব নয়। গণমাধ্যমগুলো পিতৃতান্ত্রিক মূল্যবোধ দূর করার জন্য বিভিন্ন অনুষ্ঠান প্রচার করছে, যা দেখে নারী-পুরুষ সবাই সচেতন হচ্ছে।

৪.     নারী নির্যাতন দূরীকরণে বিশেষ ভূমিকা পালনঃ- পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীরা বিভিন্ন ভাবে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে গণমাধ্যমে নারীকে উপস্থাপন করা হয় পণ্য হিসেবে। নারীদের শিক্ষার প্রসার ও সুষ্ঠ আইন প্রচার এর মাধ্যমে নারী নির্যাতন দূর করে গণমাধ্যম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।

৫.     নারীদের মধ্যে প্রণোদনা সৃষ্টি করাঃ ‘গণমাধ্যম’ এমন একটি শক্তিশালী মাধ্যম যা সহজেই মানুষের মনের উপর প্রভাব ফেলে গণমাধ্যম গুলোর মাধ্যমে নারীদের পরিকল্পনা সম্ভব হয়েছে। নারীরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে উন্নয়ন তরান্বিত করতে পারছে। গণমাধ্যম নারীদের মধ্যে প্রনোদনা সৃষ্টি করে থাকে যা উন্নয়ন সহায়ক।

৬.     জনমত গঠনঃ জনমত গঠন অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। ‘গণমাধ্যম’ জনমত গঠন করতে যথেষ্ট ভূমিকা রাখছে। জনমত গঠন করতে গণমাধ্যমগুলোকে নারী উন্নয়ন করার জন্য আমাদের সচেতন হতে হবে।

৭.     নারী বিষয়ক বিভিন্ন নীতি নির্ধারণ ও আইন প্রণয়নে সহায়তাঃ ‘গণমাধ্যম’ তথা মিডিয়া প্রতিনিয়তই নারীর উন্নয়ন চিত্রায়ন করে থাকে। টেলিভিশন, চলচিত্র বিজ্ঞাপন, সংবাদপত্র, সাহিত্য প্রভৃতি মাধ্যমে নারীর ইতিবাচক ভাব মূর্তি উপস্থাপন করা হয়। ‘গণমাধ্যম’ নারী বিষয়ক বিভিন্ন নীতি নির্ধারণ ও আইন প্রণয়নে সহায়তা করে থাকে।

পরিশেষে বলা যায় যে, ‘গণমাধ্যম’ এমন একটি শক্তিশালী মাধ্যম যা সহজেই মানুষের মনে উপর প্রভাব ফেলে তার মতাদর্শ পরিবর্তন করতে পারে। পিতৃতান্ত্রিক সমাজ নারীকে অবহেলিত করায়, গণমাধ্যমগুলো পারে পিতৃতান্ত্রিক মতাদর্শ গুলোকে পরিবর্তন করে সচেতন সমাজ গড়ে তুলতে।


২.৩ বাংলাদেশে নারী ক্ষমতায়নঃ

‘ক্ষমতায়ন’ বলতে নারীর ক্ষমতায়নকেই প্রাধান্য দেয়া হয়ে থাকে। সাধারণত উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডে নারীকে সরাসরি অংশগ্রহণ করানোর প্রক্রিয়াকে নারীর ক্ষমতায়ন বলা হয়।

জেন্ডার ও নারী উন্নয়ন বিষয়ক গবেষক ‘শামীমা পারভীন’ বলেছেন, “ নারীর ক্ষমতায়ন হচ্ছে এমন একটি প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে নারী বস্তুগত ও মানবিক সম্পদের উপর অধিকতর নিয়ন্ত্রণ অর্জন করে।”

‘হল সি মার্গারেট’ এর মতে, “ ক্ষমতায়ন সমতা লাভের দাবিকে সম্পৃক্ত করে এবং এ ক্ষেত্রে অন্য কারো নির্ভরতা নয়, বরং ব্যাক্তিকে তার নিজস্ত দাবি উপস্থাপন করতে হবে।”

সুতরাং বলা যায়, নারীর ক্ষমতায়ন হচ্ছে এমন এক প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে নারী রাষ্ট্রের সর্বস্তরে সম্মানের সাথে নাগরিকের মর্যাদা নিয়ে অংশগ্রহণ, চর্চা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় অধিষ্ঠিত হবে।

নারীর ক্ষমতায়নের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যঃ

নারীর ক্ষমতায়নের লক্ষ্য বা উদ্দেশ্যসমূহ নিম্নরুপঃ-


১.     পিতৃতান্ত্রিক মতাদর্শ ও নারীর অধস্তনতার অনুশীলনকে চ্যালেঞ্জ এবং রুপান্তর করা।

২.     কাঠামো, ব্যবস্থা ও প্রতিষ্ঠান যা নারীর প্রতি বৈষম্যকে সমন্বিত এবং জোরদার করে তা পরিবর্তন করা।

৩.     নারীর ক্ষমতায়ন পুরুষকেও ক্ষমতাবান করবে। নারীর ক্ষমতায়ন প্রক্রিয়া পুরুষের বিরুদ্ধে নয়, পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থা এবং এর সকল প্রকার প্রকাশের বিরুদ্ধে। নারীর ক্ষমতায়ন প্রক্রিয়া পুরুষকেও যুক্ত করবে। তারা নির্যাতক এবং শোষণকারীর ভূমিকা থেকে মুক্তি পাবে। নারীদের পাশাপাশি পুরষেরা গৃহকাজ এবং শিশু প্রতিপালনে অংশ নেবে।

সুতরাং পরিশেষে বলা যায়, নারী ক্ষমতায়ন দ্বারা বিশ্বকে এমন দিকে ধাবিত করা উচিত যেখানে নারী এবং সচেতন পুরুষকে নিশ্চিত করতে হবে যে সম্পদ কেবল সুষমভাবে ব্যবহৃত তবে, নিরাপদভাবে ব্যবহৃত হবে।


তৃতীয় অধ্যায়ঃ


৩.১ বাংলাদেশের ক্ষেত্রে পূর্বে নারীদের অবস্থানঃ

নারীর সামাজিক মর্যাদা ও অবস্থান খুবই প্রান্তিক বা অধস্তন। অর্থাৎ সামাজিক মর্যাদা ক্ষেত্রে বাংলাদেশে নারীর অবস্থান সর্বনিম্ন ছিল। এ দেশে পরিবারের প্রধান পুরুষ হওয়ায় পরিবারের মুখপাত্র হিসেবে তিনিই সমাজে প্রতিনিধিত্ব করেন। এ ক্ষেত্রে নারীর ভুমিকা পালনের কোন সুযোগ থাকে না ও ছিলও না। পরিবারের মধ্যে থেকে নারীর পুরো জীবনটাই পুরুষের আঙ্গুলি নির্দেশে চলছিল। অর্থাৎ পুরুষের নির্দেশনা ও নিয়ন্ত্রণে নারীর পুরো জীবন পরিচালিত হয়েছে।

১.     নারীর অবস্থানের মতাদর্শঃ পুরুষের অধস্তন হিসেবে নারীর অবস্থানের মতাদর্শ পুরুষতান্ত্রিক হেজেমনি নির্মাণে সহায়তা করে। পুরুষের সাথে সম্পর্ক নির্ণয় করার মধ্য দিয়ে নারীর পরিচয়ের সংজ্ঞা নির্ণীত হয় স্ত্রী, কন্যা বোন ও মা হিসেবে। তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোন থেকে নারীকে রক্ষনাবেক্ষণ করেন পুরুষ এবং জীবিকাও প্রদান করেন পুরুষ। মূলত পুরুষের আর্থ সামাজিক মর্যাদা নির্ণয় করে নারীর মর্যাদা।

২.     পর্দার মতাদর্শঃ পর্দার  মতাদর্শ হচ্ছে সেই মতাদর্শ, যা নারীর গতিরোধ করে এবং সমাজ সংগঠনের বিভিন্ন পর্যায়ে তার অংশগ্রহণের মাত্রা ও প্রকৃতির প্রভাবকে খর্ব করে। এটি একটি সামাজিক প্রথা বা রীতি নীতি বিশেষ। পর্দাপ্রথা এক ধরণের নিষেধাজ্ঞা কেননা পর্দা প্রথা নারীকে গৃহের বাইরে যেতে বাধা প্রদান করে।

৩.     নারীদের সম্পর্কে পূর্বের ধারণাঃ নারী বিপজ্জনক। নারীর যৌন্য আকাঙ্খা পুরুষের তুলনায় বেশি, তাই নারী সুযোগ পেলে বা স্বাধীনতা পেলে সমাজ জ্বালিয়ে পুড়িয়ে মারবে। নারী নির্ভরযোগ্য নয়। আত্মনিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা  তার নেই বাস্তব বুদ্ধি বিবেচনা তার কম, সাহস কম। তাই নারীকে গৃহে বন্ধি করে বা পর্দার আড়ালে রাখা হোক। এসব ধারণা পূর্বের নারীর ক্ষেত্রে করা হত এবং বর্তমানেও তা রয়েছে।

৪.     সম্মান ও লজ্জার ধরণাঃ পূর্বের ধারনা ছিল পর্দার অন্তরালে পৃথক পৃথিবীতে নীরব নারী হচ্ছেন আদর্শ নারী। “লজ্জা” নারীর ভূষণ এই প্রচলিত ধারনা লজ্জা রক্ষণাবেক্ষণ দ্বারা পুরুষত্বের সম্মান রক্ষার প্রয়াস চলে।

পরিশেষে বলা যায়, বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে পূর্বে নারীর অবস্থান ছিল অধঃস্থন সম্পূর্ণ এতে নারী ছিল স্বতন্ত্র, নিঃসঙ্গ ও নির্জন। আর এই নিঃসঙ্গতা ও নির্জনতা নারীকে করছিল একটি জড় পদার্থ।

৩.২ বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে বর্তমানে নারীদের অবস্থানঃ

বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে বর্তমানে নারীদের অবস্থান দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। শিল্পায়ন বৃদ্ধির সাথে সাথে নারীরা যখন বিভিন্ন শিল্প কারখানায় কাজ নেয়, তখন তাদের বাইরের কাজ বেড়ে যায়। পূর্বে গৃহের কাজ নারীর এবং বাইরের কাজ পুরুষের ছিল কিন্তু বর্তমানে নারীদের দ্বৈত ভূমিকা দেখা যাচ্ছে।

নারীর কাজের ধরণ বা অবস্থানকে দুই ভাগে ভাগ করা যায় যথাঃ-

                   ক. গৃহের কাজ

                   খ. গৃহের বাইরের কাজ।

নারীরা গৃহের কাজের ক্ষেত্রে, রান্নাবান্না, ঘর গোছানো, পরিবারের সকলের সেবা, সন্তান লালন পালনইত্যাদি কাজে নিয়োজিত থাকে। প্রক্ষান্তরে, গৃহের বাইরে কাজ হিসেবে দেখা যাচ্ছে, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, শিক্ষকতা, আইন, চিকিৎসা, গবেষণা, মডেলিং ইত্যাদি কাজে, নারীরা নিয়োজিত থাকে।

বর্তমানে নারীদের অবস্থান সম্পর্কে আলোচনা করা হলঃ-

১.     কৃষিতে নারীঃ কৃষিকাজ নারীর আবিস্কার। নারীই প্রথমে কৃষিকাজ উদ্ভাবন করে। পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম কৃষক নারী। কৃষির বিবর্তনে নারীর রয়েছে অসমান্য অবদান। বাংলাদেশের কৃষিকাজের সাথেও নারীরা গভীরভাবে সম্পৃক্ত। বাংলাদেশের মানুষের প্রধান জীবিকা কৃষি কাজকে বিশ্লেষণ করলেই দেখা যায় যে, আবহমান কাল ধরে এদেশের কৃষিক্ষেত্রে পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখে চলেছে।

২.     শিল্পে নারী ঃ শিল্পে নারীদের আশাপ্রদ অংশগ্রহণ লক্ষ্যনীয়। বিশেষতঃ পোশাক শিল্পের ব্যাপক বিকাশের ফলে, অধিক সংখ্যক নারী এ শিল্পেই নিয়োজিত। বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান শিল্প হচ্ছে পোশাক শিল্প। পোশাক শিল্প বাংলাদেশের রপ্তানি বাণিজ্যের একটি বিরাট স্থান দখল করে আছে। বাংলাদেশের প্রায় ৯০% নারী পোশাক শিল্পে নিয়োজিত রয়েছে।

অন্যান্য শিল্পে নারীদের অবস্থান ও লক্ষ্যনীয় নারীরা বর্তমানে কুটির শিল্প, মৃৎশিল্প, পাটজাত শিল্প, বাঁশবেত শিল্প, সিল্ক শিল্প, বিড়ি শিল্প, ঘানি শিল্প ইত্যাদি। গ্রামীণ নারীরা নিজ হাতে এ সকল শিল্পে ব্যাপক শ্রম দিয়ে থাকেন।

৩.     শিক্ষা বিভাগে নারীঃ শিক্ষা বিভাগে সরকারির বিভিন্ন দায়িত্বপূর্ণ পদে নারীরা নিয়োজিত রয়েছেন। যদিও গেজেটেড পর্যায়ে ১০% এবং নন-গেজেটেড পর্যায়ে ১৫% কোটা নারীদের জন্য নির্দিষ্ট রয়েছে কিন্তু কমসংখ্যক ক্ষেত্রেই এ কোটা পূরণ হয়েছে। প্রফেসর, প্রভাষক, সহকারী অধ্যাপক, প্রিন্সিপাল, ভাইস প্রিন্সিপাল, ইত্যাদি পদে নারীরা অগ্রণী ভূমিকা পালন  করছে।

৪.     প্রশাসন ও পুলিশ বিভাগে নারীঃ প্রশাসন ও পুলিশ বিভাগে বর্তমান বাংলাদেশে নারীর অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। বি.সি.এস প্রশাসনে নারী শ্রমশক্তি সচিব, অতিরিক্ত সচিব, যুগ্ম সচিব, উপ-সচিব, সিনিয়র সহকারী সচিব সহাকারী সচিব ইত্যাদি পদে অধিক ভূমিকা পালন করছে এবং পুলিশ বিভাগে নারী ইন্সপেক্টর জেনারেল , অতিরিক্ত ইন্সপেস্টর ইত্যাদি ক্ষেত্রে অধিক ভূমিকা পালন করছে।

৫.     সাংবাদিকতায় ও মিডিয়ায় নারীঃ সাংবাদিকতা একটি চ্যালেঞ্জিং পেশা। এ পেশায়ও নারীরা দক্ষতার সাথে কাজ করে যাচ্ছেন। দৈনিক, সাপ্তাহিক, মাসিক সংবাদপত্র তথা প্রিন্ট মিডিয়া ছাড়াও বর্তমানে টেলিভিশন সাংবাদিকতায় পুরুষের পাশাপাশি বিপুল সংখ্যক নারী কাজ করছেন। সাংবাদিকতায় নারীরা রিপোর্টিং সম্পাদনা, ফিচার, ব্যবস্থাপনা, কম্পিউটার, বিজ্ঞাপন ইত্যাদি ক্ষেত্রে অধিক ভূমিকা পালন করছে।

পরিশেষে বলা যায় যে, বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে বর্তমানে নারীরা কোন দিক দিয়ে পুরুষের তুলনায় পিছিয়ে নেই। নারীরা পুরুষের সাথে সাথে তাল মিলিয়ে চলতে পারে তা আমরা দেখতে পাচ্ছি। আমরা রাজনীতিতে বাংলাদেশের প্রধান প্রধান পদে বর্তমানে নারীকে দেখতে পাচ্ছি যা আগে কেউ কল্পনাও করে নাই।

সম্পূর্ণ টার্ম পেপারটি পেতে- ০১৭৩৭৭৩১০৮৫


0 comments:

Post a Comment