Thursday, March 17, 2016

Artho shamajik o Dhormio Sonskar Andolona Forayezi Andolon er Bhumika/ আর্থ সামাজিক ও ধর্মীয় সংস্কার আন্দালনে ফরায়েজা আন্দোলন

প্রথম অধ্যায়

১.১ ভুমিকা :

 ব্রিটিশ বিরোধী মনোভাবে ভারতে আর্থ-সামাজিক ও ধর্মীয় আন্দোলন দানা বেঁধে ওঠে। এক্ষেত্রে দুটি আন্দোলনের নাম সর্বাগ্রে উল্লেখযোগ্য একটি ফরাজেয়ী আন্দোলন। এবং অপরটি হচ্ছে ওয়াহাবী আন্দোলন। উভয় আন্দোলনই ঊনবিংশ শতকের প্রথম ভাগে সূচিত হয়।

ফরায়েজী আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন হাজি শরীয়তউল্লাহ আর ওয়াহাবী আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন সাঈদ আহমেদ বেরেলভী। বলা হয়ে থাকে যে, হাজি শরীয়তউল্লাহ্- ই সর্বপ্রথম তাঁর আন্দোলন সূচনা করে বাংলায় ইসলামী পুনরুজ্জীবন বাদের সূচনা করেন। পাশাপাশি সূচনা করেন সামাজিক- ধর্মীয় সংস্কারের। ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলনের ইতিহাসে ফরায়েজী আন্দোলন নিঃসন্দেহে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা।

১.২ ফরায়েজী শব্দের অর্থ :

আরবি ‘ফরজ’ শব্দ থেকে ফরায়েজী শব্দের উৎপত্তি। এর অর্থ হচ্ছে অবশ্য করণীয় কর্তব্য অর্থাৎ বাধ্যতামূলক কর্তব্য ও দায়িত্ব। কেবল সুষ্ঠুভাবে ধর্ম- কর্ম পালনের মধ্যেই এটি সীমাবদ্ধ ছিল না। ক্রমে এটি একটি আন্দোলনের রুপ পরিগ্রহ করে। হাজী শরীয়তউল্লাহ মুসলমানদের ধর্মীয় সকল প্রকার কুসংস্কার থেকে মুক্ত হয়ে তাদেরকে তাদের অবশ্য করণীয় কর্তব্য পালনের আহ্বান জানান।

তিনি লক্ষ্য করেন, তাঁর সময়ে মুসলমানরা নানা প্রকার কুসংস্কারে লিপ্ত ছিল। তারা কবর পূজা, পীর পূজা, ওরস ও মানত করে পরিত্রাণ লাভ করায় নিমগ্ন ছিল। হাজী শরীয়তউল্লাহ মুসলমানদের এসব কাজকে ধর্মীয় কুসংস্কার, অনাচার ও নৈতিক অধঃপতন হিসেবে আখ্যা দেন। তিনি এ অবস্থা দেখে বিচলিত হয়ে পড়েন এবং ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলনের ডাক দেন। তাদের আত্মশুদ্ধির জন্য ইসলাম ধর্মের পাঁচটি ফরজ পালন করার ওপর সর্বাধিক গুরুত্বারোপ করেন। এ কারণেই তাঁর এ আন্দোলনের নাম হয় ফরায়েজী আন্দোলন।

১.৩ হাজী শরীয়তউল্লাহর সংক্ষিপ্ত পরিচয় বা জীবনী:

১৭৮১ সালে বাংলাদেশের ফরিদপুর জেলার মাদারীপুর মহকুমার অন্তর্গত  বাহাদুর পুুর গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসিলম পরিবারে শরীয়তউল্লাহর জন্ম হয়। তাঁর বয়স যখন আট তখন তার পিতা আবদুল জলির তালুকদার মুত্যবরণ করেন। কলকাতায় গিয়ে তিনি আরবি ও ফার্সী ভাষায় শিক্ষা লাভ করেন। মাত্র ১৮ বছর বয়সে তিনি ধর্মীয় শিক্ষাকে আরও উত্তমরুপে জানার জন্য তিনি মক্কা গমণ করেন। শরীয়তউল্লাহ ১৭৯৯ সাল থেকে ১৮১৮ সাল পর্যন্ত মক্কায় অবস্থান করেন। সে সময়ে তিনি হজব্রত পালন করেন।

ধর্মীয় শিক্ষা পাশাপাশি শরীয়তউল্লাহ রাজনৈতিক মতাদর্শেও উদ্বুদ্ধ হন। সে সময়ে ওয়াহাবী মতাদর্শ দিয়ে বিশেষভাবে প্রভাবিত হন। তিনি ধর্মীয় সংস্কারের চেতনা লাভ করেন। ১৮১৮ সালে তিনি সদেশে প্রত্যাবর্তন করেন তাঁর ফরায়েজী মহবাদ জোরেশোরে প্রচার চালাতে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে শরীয়তউল্লাহ মুসলমানদের সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনকেও বৈপ্লবিক চেতনায় আলোড়িত করতে প্রয়াসী হন। ১৮৪০ সালে এই মহান ব্যক্তির মুত্যু ঘটে।


১.৪ ফরায়েজী আন্দোলরে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ঃ


ফরায়েজী  আন্দোলন কতিপয় লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে অগ্রসর হয়। সেগুলো ছিল নি¤œরুপ ঃ

১.     মুসলমান জাতিকে  সকল প্রকার পঙ্কিলতা থেকে উদ্ধার করে ইসলামের প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলা।

২.     সকল মুসলমানকে ইসলামী মূলনীতি তথা ফরজ-এর ওপর প্রতিষ্ঠিত করা।

৩.     ইসলাম বিরোধী সকল কার্যকলাপ ও কুসংস্কার রোধে মুসলমানদের উদ্বুদ্ধ করা।

৪.     মুসলমানদের সকল প্রকার নৈতিক বলে বলীয়ান করা।

৫.     মুসলমানদের অধিকার ও কর্তব্য পালনে সচেতন ও আত্মবিশ্বাসী করে তোলা।

৬.     ইংরেজ সরকারের সকল জুলুম ও অত্যাচারের প্রতিবাদ জানানো।

৭.     জমিদার শ্রেণীর সকল অত্যাচার -অনাচারের প্রতিবাদ করা।

৮.     ইংরেজদের ভারতবর্ষ থেকে বিতাড়িত করা।

৯.     ভারতবর্ষকে স্বাধীন করা।

হাজী শরীয়তউল্লাহর ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের জমিদার ও নীলকরদের বিরুদ্ধে পরিচালিত হয়। প্রধানত ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলন হিসেবে শুরু হলেও ক্রমে তা আর্থ-সামাজিক আন্দোলনে পরিণত হয়। এ আন্দোলনে শ্রমিক- কৃষকদের স্বার্থকে সকলের ওপর স্থান দেওয়া হয়। শ্রমিক-কৃষককুল ভূস্বামী ও জমিদার শ্রেণির বিরুদ্ধে দন্ডায়মান হয়। হাজী শরীয়তউল্লাহ তাদেরকে ভূস্বামী ও জমিদারদের বিরুদ্ধাচার করতে উৎসাহিত করেন।

এছাড়া অত্যাচারী জমিদারদের হাত থেকে শ্রমিক- কৃষকদের রক্ষা করার জন্য ১৮৩১ সালে একটি লাঠিয়াল বাহিনী তৈরি করেন শরীয়তউল্লাহ। এ কাজে তিনি তাঁর অনেক অনুসারীদের সহযোগিতা লাভ করেন। এটি প্রত্যক্ষ করে ইংরেজরা শরীয়তউল্লাহ ও তাঁর অনুসারীদের ওপর ক্ষিপ্ত হযে পুলিশী নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। এরপর থেকে জমিদারদের সঙ্গে সংঘর্ষ পরিহার করে চলেন।

১৮৪০ সালে ৫৯ বছর বয়সে হাজী শরীয়তউল্লাহ্ মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর গ্রামের বাড়িতে তাঁকে সমাহিত করা হয়। শরীয়তউল্লাহর মৃত্যুর পর তার একমাত্র পুত্র মোহসিন উদ্দিন ওরফে দুদু মিয়া পিতার স্থলাভিষিক্ত হন।

দুদু মিয়া তাঁর পিতার ন্যায় পন্ডিত ছিলেন না বটে কিন্তু ফরায়েজী  আন্দোলনের ইতিহাসে তিনি এক অনন্য ভূমিকা পালন করেন। ফরায়েজী আন্দোলনের মাধ্যমে তিনি মুসলমানদের মধ্যে এক সুদৃঢ় ভ্রাতৃত্ববোধ গড়ে তোলেন। ফলে ভারতবর্ষে এক শক্তিশালী ফরায়েজী সমাজ প্রতিষ্ঠা পায়। এ সমাজের উদ্দেশ্য ছিল দু’টো-

১   জমিদার ও নীলকদের অত্যাচার থেকে কৃষককুলকে রক্ষা।

২ফরায়েজীদের মধ্যে উঁচু-নীচু ভেদাভেদ দূর করে সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠা করা।



১.৫ ফরায়েজী আন্দোলনের বৈশিষ্ট্যসমূহ ঃ

ফরায়েজী আন্দোলনের একাধিক বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়:

১.     ফরায়েজী আন্দোলন এক শুদ্ধি ও সংস্কার আন্দোলন।

২.     ফরায়েজী আন্দোলন এক বিশেষ সম্প্রদায়ের আন্দোলন।

৩.     এ আন্দোলন ছিল মূলত একটি এলাকাভিত্তিক আন্দোলন।

৪.     এটি ছিল কৃষক ও শ্রমিক শ্রেণীর অর্থনৈতিক মুক্তির আন্দোলন।

৫.     এটি ছিল প্রধানত এলাকাভিত্তিক আন্দোলন।




দ্বিতীয় অধ্যায়

২.১   ধর্মীয় সংস্কারের হাজী শরীয়তউল্লাহ ঃ

ধর্মীয় সংস্কারের লক্ষ্যে হাজী শরীয়তউল্লাহ-র পদক্ষেপসমূহ ঃ

১.     হাজী শরীয়তউল্লাহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ইসলামী শিক্ষা ও আদর্শ প্রচার করেন।

২.     ইসলামে ধনসম্পদ বা বংশ মর্যাদার ভিত্তিতে কোন রকম তরতম্য বা ভেদাভেদ করা হয় না। এখানে সকলেই সমান।

৩.     শরীয়তউল্লাহ্ ‘পীর’ ও ‘মুরিদ’ শব্দ প্রভু ও ভৃত্য সম্পর্ক নির্দেশ করে বিধায় এর পরিবর্তে ‘ওস্তাদ’ ও ‘সাগরেদ’ শব্দ ব্যবহার করার ওপর গুরুত্বারোপ করেন।

৪.     শরীয়তউল্লাহ তৎকালীন মুসলিম সমাজে প্রচলিত বিভিন্ন অনৈসলামিক রীতিনীতি ও আচার অনুষ্ঠান ‘শিরক’ এবং ‘বেদাত’ বলে অভিহিত করেন। মুসলমানদের তিনি এসব বর্জন করতে বলেন।

৫.     ধর্মীয় কর্তব্যের পাশাপাশি পার্থিব কর্তব্যের ওপরও শরীয়তউল্লাহ সমান গুরুত্ব প্রদান করেন। শ্রমলব্ধ উপার্জনকে তিনি হালাল রুজি হিসেবে উঁচু স্থান প্রদান করেন।

শরীয়তউল্লাহ ধর্ম প্রচার এবং ধর্মীয় সংস্কার করতে গিয়ে কোন প্রকার রাজনৈতিক প্রভাবে প্রভাবিত হননি। তিনি সর্বদাই শান্তিপূর্ণ সংস্কারের বিশ্বাসী ছিলেন।


২.২ ফরায়েজী আন্দোলন ও ব্রিটিশ-বিরোধী মনোভাব ও আন্দোলন ঃ

ফরায়েজী আন্দোলনে ব্রিটিশ বিরোধী মনোভাব পরিলক্ষিত হয়। শরীয়তউল্লাহর মতে, ব্রিটিশ শাসনের অধীনে ভারতের মুসলমানরা পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ ছিল। তারা সত্যিকারভাবে ইসলামী জীবনযাপন করতে সক্ষম ছিল না। শরীয়তউল্লাহ্ এজন্য ব্রিটিশ শাসনের অধীনে ভারতবর্ষকে ‘দারুল হারব’ (বিধর্মীর রাজ্য) হিসেবে আখ্যায়িত করেন। এ কারণে মুসলমানদের উচিত ইংরেজদের ভারত থেকে বিতাড়িত করা।

হাজী শরীয়তউল্লাহ্ ফতোয়া প্রদান করেন যে, অমুসলিম শাসিত দেশে জুম্মার নামাজ এবং ঈদুল ফিতর এবং ঈদুল আজ্হা উদযাপন করা নিষেধ। তিনি মুসলমানদের জুম্মার নামাজের পরিবর্তে যোহরের নাম পড়ার উপদেশ দেন। শরীয়তউল্লাহ এই ধারণা স্বাভাবিকভাবেই মুসলমানরা প্রতিরোধ করে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এটি ছিল ইংরেজদের প্রতি একটি চ্যালেঞ্জ। অর্থাৎ মুসলমানদের উচিত ইংরেজদের বিতাড়িত করে বৈধভাবে জুম্মার নামাজ পড়ার জন্য এক বলিষ্ঠ আহ্বান। শরীয়তউল্লাহ্ ঈদ এবং অন্যান্য উৎসবে গরু কোরবানিন করতে উৎসাহিত করেন।


২.৩ ফরায়েজী আন্দোলনে দুদু মিয়ার অবদানঃ

১৮৪০ সালে হাজী শরীয়তউল্লাহর মৃত্যুর পর ফরায়েজী আন্দোলনের নেতৃত্বে তার পুত্র মুহসিন উদ্দীন ওরফে দুদু মিয়ার ওপর ন্যাস্ত হয়। এ আন্দোলনে দুদু মিয়া অত্যন্ত  গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। তিনি ফরায়েজীদের রাজনৈতিকভাবে সংঘবদ্ধ করে তাদের মধ্যে সাহস ও আত্মবিশ্বাস জাগ্রত করেন। যার ফলে ফরায়েজী আন্দোলন একটি রাজনৈতিক আন্দোলন ও সংগঠন হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে সক্ষম হয়। এ সময়ে হিন্দু জমিদারগণ ফরায়েজীদের দুর্বল করার ন্য ইংরেজ নীলকরদের সাথে আঁতাত করে ইংরেজ প্রশাসনকে ফরায়েজীদের বিরুদ্ধে প্ররোচিত করতে তৎপর হয়। অপরপক্ষে দুদু মিয়া অত্যাচারী জমিদার ও নীলকরদের শোষণের বিরুদ্ধে কৃষক-রায়তদেরকে ঐক্যবদ্ধভাবে ফরায়েজীদের পক্ষে যোগদানের উদ্যত্ত আহ্বান জানান। ফলে জোতদার জমিদার ও নীলকরদের নিপীড়ন ও অর্থনৈতিক শোষণ থেকে মুক্তির জন্য অসংখ্য রায়ত ও কৃষক সম্প্রদায় জাতি, ধর্ম নির্বিশেষে ফরায়েজীদের পক্ষে যোগদান করেন। দুদু মিয়া অথ্যাচারী জমিদার ও নীলকরদের বিরুদ্ধে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ ও শক্তিশালী করে এক বিপ্লব গড়ে তোলেন। বাংলায় কৃক, শ্রমিক, কারিগর প্রভৃতি দরিদ্র ও নির্যাতিত মানুষের প্রতি সমবেদনা প্রকাশ ও সবরকমের শোষণ থেকে মুক্তির আহ্বান দুদু মিয়াকে অত্যন্ত জনপ্রিয় করে তোলে। ক্রমেই দুদু মিয়া পরিচালিত ফরায়েজি আন্দোলন রাজনৈতিক আন্দোলনে রুপ লাভ করতে থাকে। এ আন্দোলনের তিনি কতিপয় অবদান রেখেছিলেন যা নিচে আলোচনা করা হল:

১.     শক্তিশালী লাঠিয়াল বাহিনী গঠন ও প্রশিক্ষণ প্রদান ঃ দুদু মিয়া ফরায়েজী আন্দোলনের নেতৃত্ব গ্রহণের পর এ আন্দোলনকে সংগঠিত ও শক্তিশালী করার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। উল্লেখ্য, পিতার জীবদ্দশায় জমিদারদের সাথে ফরায়েজীদের সংঘর্ষের সমন্বয়ে একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা গভীরভাবে উপলব্ধি করেন। এজন্য তিনি প্রতিপক্ষের শক্তির মোকাবেলর জন্য স্বীয় দলের শক্তি বৃদ্ধি লক্ষ্যে একটি শক্তিশালী লাঠিয়াল বাহিনী গড়ে তোলেন। তিনি নিজ লাঠিচালনা শিক্ষা করেন এবং তার বাহিনীকে লাঠি চালনার প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থা করেন।

২.     খিলাফত প্রতিষ্ঠা ঃ ফরায়েজী আন্দোলন ক্রমেই রাজনৈতিক আন্দোলনে রুপ লাভ করে। দুদু মিয়া গ্রাম বাংলায় জনগণকে ইংরেজ শাসকদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর আহ্বান করেন। সরকারের পাশাপাশি তিনি একটি সুশৃঙ্খল প্রশাসন গড়ে তোলেন- এ প্রশাসনকে ফরায়েজী খিলাফত নামে আখ্যায়িত করা হয়।

৩.     জনগণের মধ্যে সাহস ও আত্মবিশ্বাস সৃষ্টি ঃ দুদু মিয়া জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করেন এবং তাদের মধ্যে সংহতি সৎ দৃঢ় মনোবল সৃষ্টির লক্ষ্যে তাদেরকে সাহজ ও আত্মবিশ্বাসের চেতনায় উজ্জীবিত করেন।

৪.     গ্রামীণ পঞ্চায়েতর পুনরুজ্জীবিতকরণ ঃ তিনি জমিদার ও নীলকরদের অত্যাচার থেকে নির্যাতিত ও নিপীড়িত রায়ত ও কৃষকদের রক্ষা করার উদ্দেশ্যে বাংলার পুরাতন ঐতিবাহী গ্রামীণ  সংগঠন  পঞ্চায়েত ব্যবস্থা পুনরুজ্জীবিত করেন। তিনি মুসলমান ধর্মজ্ঞানী বর্ষীয়ান অনুসারীদেরকে এক গ্রামীণ আদালত বা পঞ্চায়েতের বিচারক নিযুক্ত করেন। সাম্য ও ন্যায়বিচারের মাধ্যমে সবরকম মীমাংসার ব্যবস্থা করেন। ফরে ফরায়েজী অধ্যুষিত অঞ্চল থেকে ইংরেজ কোর্ট -কাচারিতে মামলা- মোকদ্দমা দায়ের বহুলাংশে হ্রাস পায়।

৫.     কানাইপুরের জমিদারের বিরুদ্ধে অভিযান ঃ ফরায়েজী আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানিয়ে এক সময় প্রজারা পূজা কর দিতে অস্বীকৃতি জানালে কানাইপুরের জমিদারগণ তাদের ওপর নির্যাতন শুরু করে। ফরায়েজীদের প্রকাশ্যে গরু কোরবানীকেও তারা সহজভাবে গ্রহণ করেনি। অধিকন্তু জমিদাররা তদের প্রদাদেরকে ফরায়েজী আন্দোলনে অংশগ্রহণ থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করতেন এবং অনেক ক্ষেত্রে অবাধ্য ব্যক্তিদের শাস্তি দেয়া হতো বলে জানা যায। দুদু মিয়া এ অন্যায়ের বিরুদ্ধে তার লাঠিয়ালবাহিনী নিয়ে অগ্রসর হন। জমিদাররা দুদু মিয়ার বিরুদ্ধে বল প্রয়োগ করতে সাহসী হলেন না, বরং আপোষ করেন। আপোষ অনুযায়ী জমিদারগণ সকর প্রকার অন্যায় কর ও পূজা কর এবং প্রজাদের প্রতি নির্যাতনমূলক ব্যবস্থা প্রত্যাহার করতে বাধ্য হন।

৬.     ঘোষ জমিদারদের বিরুদ্ধে অভিযান ঃ কানাইপুরের জমিদারদের বিরুদ্ধে সাফল্যে উৎসাহিত হয়ে দুদু মিয়া ১৮৪২ সালে ফরিদপুরের শক্তিশালী ঘোষ পরিবারের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করেন। ফরায়েজী জমিদারদের ঘর বাড়ি বিধ্বস্ত করে এবং জমিদারদের  ভাই মদন নারায়ণকে বন্দি করে রাখে। এ ঘটনার জন্য দুদু মিয়ার দলের ১১৭ জনকে গ্রেফতার করেন। কিন্তু দুদু মিয়ার বিরুদ্ধে কোন সাক্ষ্য প্রমাণ না পাওয়ায় তাকে মুক্তি দেয়া হয়। অত্যাচারী জমিদারদের বিরুদ্ধে দুদু মিয়ার সংগ্রামের সাফল্য চারদিকে ছড়িযে পড়ে এবং জনগণের মধ্যে তার আন্দোলনের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ সৃষ্টি হয়। ফরিদপুর, পাবনা, বাখেরগঞ্জ, ঢাকা ও নোয়াখালী জেলার ঘরে ঘরে তার শ্রদ্ধাভরে উচ্চারিত হয়। নিপীড়িত জনগণ দলে দলে তার পতাকাতলে সমবেত হতে থাকে। দুদু মিয়ার নেতৃত্বে প্রজা বিদ্রোহ দমনার্থে হিন্দু জমিদাররা নীলকরদের প্ররোচিত করে। এভাবে ষড়যন্ত্র করে জনৈক নীলকর সাহেবের মাধ্যমে দুদু মিয়াকে কয়েকবার গ্রেফতার করে দোষী সাব্যস্ত করার অপপ্রয়াস চালিয়েও ব্যর্থ হয়।

৭.     নীলকরদের বিরুদ্ধে অভিযান ঃ দুদু মিয়া তৎকালীন অত্যাচারী নীলকরদের বিরুদ্ধেও সোচ্চার ভূমিকা পালন করেন। তৎকালীন ফরিদপুরের নীলকর মি. ডানলপের কালিপ্রসন্ন কাঞ্চিলাল নামক জনৈক ব্রাহ্মণ গোমস্তা তার পাঁচ চরের নীল কুঠির দেখাশুনা করার সুবাদে প্রভাবশালী হয়ে পড়েন। এ গোমস্তা দুদু মিয়ার সাথে শত্রুতা শুরু করেন। এ গোমস্তা তার দলবলসহ দুদু মিয়ার বাড়তে ডাকাতি ও লুণ্ঠন চালায় এবং চারজন চৌকিদারকে হত্যা করেন। কিন্তু ডানলপের প্রভাবের কারণে পুলিশ ও ম্যাজিস্ট্রেট এ অন্যায় কাজের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গহ্রণ করে নি। বাধ্য হয়ে দুদু মিয়া নিজেই কাঞ্চিলালের বিরুদ্ধে শাস্তিমুল ব্যস্থা গ্রহণের উদ্যেগ গ্রহণ করেন। ১৮৪৬ সালের ৫ ডিসেম্বর দুদু মিয়া ডানলপ সাহেবের নীলকুঠি ধ্বংস করেন এবং ব্রাহ্মণ গোমস্তাকে বন্দি ও হত্যা করেন। এ অভিযানে তিনি প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ না করলেও বিচারে ৬৬ জন অনুগামীসহ তার শাস্তি হয়। পরে সদর নিযামত আদালতে আপীল করে দুদু মিয়া ও তার অনুসারীরার মুক্তি পায়। এতে দুদু মিয়ার প্রবাব প্রতিপত্তি ও জনপ্রিয়তা আরো বেড়ে যায়।

৮.     দুদু মিয়ার শেষ জীবন ঃ হাজী শরিয়তউল্লাহ-এর প্রতিষ্ঠিত ফরায়েজী আন্দোলনকে ধর্ম সংস্কার আন্দোলন থেকে দুদু মিয়ার রাজনৈতিক আন্দোলন তথা মানবতার সার্বিক মুক্তির আন্দোলনে রুপান্তরিত করেন। কাজেই ফরায়েজী আন্দোলে দুদু মিয়ার অবদান  ছিল অপরিসীম। তবে ১৮৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহ শুরু হলে ব্রিটিশ সরকার দুদু মিয়াকে কলকাতার আশঙ্কা ছিল যে, তিনি সিপাহী বিদ্রোহে অংশগ্রহণ করতে পারেন। আদালত দুদু মিয়াকে বলেছিলেন যে, তার আহ্বানে ৫০,০০০ লোক সাড়া দেবে এবং তিনি যেখানে যেতে বলবেন তারা সেখানেই যাবেন। তাই ব্রিটিশ সরকার সিপাহী বিদ্রোহ শেষ না হওয়া পর্যন্ত দুদু মিয়াকে কারাগারে আটক রাখেন। কারাগার থেকে মুক্তিলাভের পর ১৮৬০ সালে তিনি ঢাকায় ১৩৭ নং বংশাল রোডে বসবাস শুরু করেন। অতঃপর ১৮৬২ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।











তৃতীয় অধ্যায়

৩.১ ফরায়েজী আন্দোলনের ব্যর্থতার কারণ ঃ

হাজী শরীয়তউল্লাহ এবং তাঁর পুত্র দুদু মিয়ার নেতৃত্বে পরিচালিত ফরায়েজী আন্দোলন অবশেষে ব্যর্থতায় পর্যবসীত হয়। এর ব্যর্থতর পেছনে যেসব কারণ কাজ করেছিল সেগুলো ছিল নি¤œরুপ :

১.     সংকীর্ণ ধর্মীয় অনুভূতি ঃ ফরায়েজী আন্দোলন মূলত সংকীণ ধর্মীয় অনুভূতি চেতনার ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছিল। সমাজের সকল শ্রেণি, গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের সমর্থন ছিল এই আন্দোলনে অনুপস্থিত। বিশেষকরে হিন্দু কৃষক ও শ্রমিক শ্রেণির সমর্থন এটি লাভ করতে পারেনি।

২.     সুনির্দিষ্ট ও সুস্পষ্ট লক্ষ্যের অভাব ঃ ফরায়েজীদের আন্দোলনের পেছনে তেমন কোন সুনির্দিষ্ট ও সুস্পষ্ট লক্ষ্য ছিল না বললেই চলে। তারা জমিদার ও নীলকরদের বিরুদ্ধে আন্দোলনের সূচনা করেছিলেন বটে কিন্তু এছাড়া অন্য কোন ইতিবাচক কর্মসূচি তরা গ্রহণ করেন নি।

৩.     শরীয়তউল্লাহ্র ধর্ম সংস্কারের অপব্যাখ্যা ঃ গোড়াপন্থী মুসলমানরা শরীয়তউল্লাহ্র ধর্মীয় সংস্কার সংক্রান্ত কর্মকান্ডের অপব্যাখ্যা করতে থাকেন। তায়াইয়ুমী মতবাদের দর্মীয় প্রচারক মাওলানা কেরামত আলী জৌনপুর শরীয়তউল্লাহ্র ফরায়েজী মতবাদকে অত্যন্ত তীব্র ও জোরালো ভাষায় সমালোচনা করতে শুরু করেন। তিনি এবং তার অনুসারীরা হাজী শরীয়তউল্লাহ্র বিরোধীতা করেন। তিনি ইংরেজদের সাথে সম্ভায় রাখার পক্ষপাতি ছিলেন। ইংরেজ শাসনাধীন ভারতবর্ষের ’দারুল হরব’ না বলে তিনি একে ‘দারুল আমন’ অর্থাৎ নিরাপত্তার দেশ বলে জনগণের সামনে বক্তৃতা-বিবৃতি দিতে থাকেন।

৪.     জমিদারী প্রথা উচ্ছেদের নেতিবাচক কর্মসূচি ঃ হাজী শরীয়তউল্লাহ্ এবং দুদু মিয়া তাঁদের আন্দোলনকে জমিদারী প্রথা উচ্ছেদের বিরুদ্ধে আন্দোলন হিসেবে চিত্রিত করেন। কিন্তু তাঁদের এ আন্দোলন ছিল নিতিবাচক, কোন ধরনের ইতিবাচক কর্মসূচি ও কার্যক্রম তাঁরা দেখাতে পারেনি। জমিদারদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে তাঁরা কথা বলেছেন কিন্তু তাদেরকে উচ্ছেদেরে কোন জোরালো দাবি জানাননি।

৫.     সুযোগ্য নেতৃত্বের অভাব ঃ হাজী শরীয়তউল্লাহ যতদিন জীবিত ছিল ততদিন তিনি ফরায়েজী আন্দোলন উত্তমভাবে নেতৃত্ব দিয়ে ছিলেন। এমনকি তাঁর মৃত্যুর পরও তাঁর পুত্র দুদু মিয়ার পিতার নেতৃত্বকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সক্ষম হন। কিন্তু দুদু মিয়ার মৃত্যুর পর এই আন্দোলনে নেতৃত্বের অভাব দেখা দেয়। এতে করে আন্দোলন ক্রমশ গতিবেগ হারিয়ে ফেলতে থাকে।

৩.২ ফরায়েজী আন্দোলনের প্রভাব, প্রতিক্রিয়া ও গুরুত্ব ঃ

ফরায়েজী আন্দোলনের প্রভাব, প্রতিক্রিয়া ও গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। এ আন্দোলনের ভারতবর্ষে বিশেষকরে বাংলায় এক সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলে। তৎকালীন অখন্ড বাংলার কুসংস্কারাচ্ছন্ন মুসলমান সমাজে এ আন্দোলনের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। বাংলার মুসলিম সমাজ নিজেদের অবস্থান সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠে। তারা আত্মপ্রত্যয়ী হয়ে ওঠে, তাদের স্থবির চিন্তা চেতনা গতিশীল হয়ে ওঠে।

ফরায়েজী আন্দোলন ছিল সমাজের শোষিত, নিপীড়িত জনগণের পক্ষে। শুধু ধর্মীয় ক্ষেত্রেই নয়, সমাজের অন্যান্য ক্ষেত্রেও এ আন্দোলন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে শুরু করে।

এই আন্দোলন ছিল মুলত কৃষক আন্দোলন। তৎকালীন সময়ে কৃষককুল নানাভাবে জমিদার ও নীলকরদের নির্যাতনে শিকর হত। অতি অল্প সময়ের মধ্যে শরীয়তউল্লাহ্ কৃষকদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস সৃষ্টি করে তাদেরকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ করতে প্রয়াস পান এবং এ কাজে তিনি কৃতকার্য হন। তিনি কৃষকদের মধ্যে শিক্ষার আলো প্রজ্জলন করেন। কোরআনের সঠিক শিক্ষায় তিনি তাদেরকে শিক্ষিত করে তোলেন। মুসলিম সম্প্রদায় যুক্তিবাদী ও প্রতিবাদী হয়ে ওঠে।

0 comments:

Post a Comment